নামকরণ
বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা মোঘল-পূর্ব যুগে কিছু গুরুত্বধারন করলেও শহরটি ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করে মোঘল যুগে। ঢাকা নামের উৎপত্তি সম্পর্কে স্পষ্ট করে তেমন কিছু জানা যায় না। এ সম্পর্কে প্রচলিত মতগুলোর মধ্যে কয়েকটি নিম্নরূপঃ ক) একসময় এ অঞ্চলে প্রচুর ঢাক গাছ (বুটি ফুডোসা) ছিল; খ) রাজধানী উদ্বোধনের দিনে ইসলাম খানের নির্দেশে এখানে ঢাক অর্থাৎ ড্রাম বাজানো হয়েছিল; গ) ‘ঢাকাভাষা’ নামে একটি প্রাকৃত ভাষা এখানে প্রচলিত ছিল; ঘ) রাজতরঙ্গিণী-তে ঢাক্কা শব্দটি ‘পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র’ হিসেবে উল্লেখিত হয়েছে অথবা এলাহাবাদ শিলালিপিতে উল্লেখিত সমুদ্রগুপ্তের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ডবাকই হলো ঢাকা। মোঘল পূর্ব যুগের পুরাতাত্বিক নিদর্শন হিসেবে ঢাকা শহরে দু’টি এবং মিরপুরে একটি মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে প্রাচীনতমটির নির্মাণ তারিখ ১৪৫৬ খ্রিষ্টাব্দ (জোয়াও দ্য ব্যারোস ঢাকাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে দেখতে পান এবং ১৫৫০ খ্রিষ্টাব্দে তার অঙ্কিত মানচিত্রে এর অবস্থান নির্দেশ করেন।
আকবর নামা গ্রন্থে ঢাকা একটি থানা (সামরিক ফাঁড়ি) হিসেবে এবং আইন-ই- আকবরী গ্রন্থে সরকার বাজুহার একটি পরগনা হিসেবে ঢাকা বাজু উল্লিখিত হয়েছে। ১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে ইসলাম খান চিশতি সুবাহ বাংলার রাজধানী রাজমহল থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করেন এবং সম্রাটের নামানুসারে এর নামকরণ করে জাহাঙ্গীরনগর।
প্রশাসনিকভাবে জাহাঙ্গীরনগর নামকরণ হলেও সাধারণ মানুষের মুখে ঢাকা নামটিই থেকে যায়। সকল বিদেশী পর্যটক এবং বিদেশী কোম্পানির কর্মকর্তারাও তাদের বিবরণ এবং চিঠিপত্রে ঢাকা নামটি ব্যবহার করেন।
ঐতিহাসিক ঘটনাবলী ও প্রশাসনিক বিবর্তন
মুসলিম পূর্ব যুগে বর্তমান ঢাকা জেলা অঞ্চল ‘বঙ্গ’ নামে পরিচিত প্রশাসনিক অঞ্চলের অন্তর্ভূক্ত ছিল। এর কিয়দংশ কখনো কখনো সমতট এবং কখনো কখনো হরিকল নামে পরিচিত ছিল। এয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজী বঙ্গ দেশে সেন রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে মুসলিম রাজত্বের সূচনা করেন।
মোঘল যুগের পূর্বে বাংলার হিন্দু ও মুসলিম শাসকেরা ঢাকার চারিদিকের বিভিন্ন অবস্থানে তাদের রাজধানী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এসব রাজধানী নগরীর কয়েকটি নিদর্শন এখনো বিক্রমপুর, ভাওয়াল ও সোনারগাঁওয়ে দেখা যায়। ১৫৭৫ সালে মোঘলরা পাঠান সুলতানের কাছ থেকে বাংলার শাসনভার ছিনিয়ে নিলেও তাদেরকে বাংলার ভূস্বামী বা ভূইয়াদেরকে নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য যথেষ্ঠ বেগ পেতে হয়।
১৬১০ খ্রিষ্টাব্দে প্রাদেশিক রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠার পর প্রায় একশত বছর ঢাকার মর্যাদা অক্ষুণ্ণ ছিল। এ শহরে ছিল প্রশাসনিক সদর দফতর এবং সুবাহদার ও অন্যান্য কর্মচারীদের বাসস্থান। ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক কারণে মাহজাদা সুজা (১৬৩৯-৫৯) রাজধানী স্থানান্তর করেন। সুবাহদারি স্থানান্তরিত হলে ঢাকা রাজধানীর গুরুত্ব হারিয়ে একটি স্থানীয় প্রশাসনিক কেন্দ্রে পরিণত হয়।
পরবর্তী সুবাহদার শাহ সুজা ঢাকায় নির্মাণ কর্মকান্ড শুরু করেন। শাহ সুজার দীউয়ান মীর আবুল কাশিম ১৬৪৫ খ্রিষ্টাব্দে বড় নামে একটি সুপ্রশস্ত ইমারত নির্মাণ করেছিলেন। ইমারতটির অবস্থান বুড়িগঙ্গার তীরে এবং বর্তমান চকবাজারের দক্ষিণে।
ঢাকার ইতিহাসে বেশ কয়েকটি নির্মাণ কাজের সঙ্গে মীরজুমলা নাম জড়িয়ে আছে, প্রথমে মীরজুমলার গেট পরবর্তী সময়ে যা রমনা গেট নামে পরিচিত হয়। কার্জন হল এর কাছাকাছি ও পুরাতন হাইকোর্ট ভবনের পশ্চিমে ময়মনসিংহ রোডে গেটটি অবস্থিত।
পরবর্তী সুবাদার শায়েস্তা খান ছিলেন একজন খ্যাতিমান নির্মাতা। অবশ্য তিনি একটি কাটরাও নির্মাণ করেন। এটি ছোট কাটরা নামে পরিচিত, শাহ সুজার বড় কাটরা থেকে পৃথক করার জন্য এ নামকরণ। তিনি বেশ কয়েকটি মসজিদ ও সমাধিসৌধও নির্মাণ করেন। মসজিদ গুলির মধ্যে চকবাজার মসজিদ, বাবুবাজার মসজিদ ও সাতগম্বুজ মসজিদ বিখ্যাত। সমাধিগুলির মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে বিবি পরীর সমাধি।
নদীপথের পাশে অবস্থানের কারণে ঢাকা প্রাক-মোঘল যুগেই স্থানীয় বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল। কেননা ঢাকা ছিল একটি উৎপাদন কেন্দ্র।
এখানে উৎপাদিত সুতিবস্ত্র উচ্চমান সম্পন্ন এবং বহির্বিশ্বে ছিল এর প্রচুর চাহিদা। মসলিন নামে পরিচিত বিভিন্ন ধরনের সুতিবস্ত্র বাইরে রপ্তানি হতো। এ সব ক্রয়ের জন্য ইউরোপীয় কোম্পানীগুলো আমদানি করত প্রচুর স্বর্ণ ও রৌপ্য পিন্ড।
বাংলার নওয়াবদের রাজনৈতিক ক্ষমতার পতন এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উত্থান আঠারো শতকের শেষভাগে ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্বকে ম্লান করে দেয়। উপরন্তু, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্যিক ও উৎপাদন নীতি নগরীর আর্থিক ভিত্তিকে ধ্বংস করে দেয়।
উন্নয়নের নতুন ধারা এবং সমৃদ্ধির নতুন যুগের সূত্রপাতের মাধ্যমে ১৮৪০- এর দশক নগর ইতিহাসে নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা করে। নগর উন্নয়নের এ যাত্রা তখন থেকেই অব্যাহতভাবে চলতে থাকে। প্রশাসনিক ক্রমবৃদ্ধি ইতঃপূর্বে ঢাকা জেলা প্রশাসনের কেন্দ্র ছিল। এটি ১৮২৯ সালে ঢাকা বিভাগ নামে একটি বৃহৎ বিভাগের সদর দফতরে পরিণত হয়। এরপর ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্ব বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ১৮৮৫ সালের মধ্যে বঙ্গপ্রদেশে কলকাতার পরে ঢাকা নগরীকে সর্ববৃহৎ বেসামরিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়।
১৯০৫-১১ সালের দিকে ঢাকার প্রশাসনিক গুরুত্ব নাটকীয়ভাবে আরও বৃদ্ধি পায় যখন এটিকে পূর্ব বাংলা ও আসাম নামে নতুন প্রদেশের রাজধানী করা হয়। একটি হাইকোর্ট এবং একটি সচিবালয়সহ একজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর নিযুক্ত করা হয়।
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান এবং স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব বাংলা নামে নতুন প্রদেশের রাজধানী হওয়ায় ঢাকার উথানে অধিকতর স্থায়ী উন্নয়ন সাধিত হয়। এ সময় হতে ঢাকা শুধু এ নতুন প্রদেশের প্রশাসনিক সদর দফতরই ছিল না বরং এখানে আইন পরিষদ এবং জাতীয় সংসদের অধিবেশন বসত।
অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে নয়মাস সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের রাজধানী হিসেবে ঢাকা রাজনৈতিক , প্রশাসনিক কার্যকলাপ এবং অর্থনৈতিক, সামাজিক, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্ররূপে মর্যাদা লাভ করে